মানবজাতি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী একটি মহাসংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। সম্ভবত মানবজাতির ইতিহাসে এমনসংকটের মুখোমুখি মানবজাতি পরেনি। আগামীতে করোনা ভাইরাস এমন একটি ঘটনা হিসেবে স্মরণ হবে যেখানে এটিকেবলমাত্র একটি
মহামারী হিসেবেই নয়, স্মরণকালের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনও ঘটে যাবে করোনা ভাইরাস মুক্ত হওয়ারপর।সামান্য এক অদেখা ক্ষুদ্র ভাইরাস পৃথিবাীর সব হিসাব-নিকাশ আর চিরায়ত বিশ্বাসকে ভেঙ্গে একেবারে চুরমার করেদিচ্ছে।
কোন একটি গুলি, বোমা ছাড়াই পৃথিবীর প্রায় ৬ বিলিয়ন মানুষ আজ গৃহবন্দী, উপাসনালয়গুলো খালি পড়ে আছে,ডাক্তার রোগী দেখতে অস্বীকার করছে, অসুস্থ্য প্রিয়জনের শয্যাপাশে প্রিয়জন থাকবে না, নিষিদ্ধ হিজাবের দেশে মাস্ক পরাবাধ্যতামূলক হবে, যুদ্ধ জয়ের জন্য যে মিলিটারীকে একত্রিত করা হয়, এখন বাচাঁর জন্য তাদেরকে আলাদা করা হচ্ছে।মাত্র তিন মাস আগে জি-২০ দেশ গুলি অহংকারের সাথে বলেছিল, সামরিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে তাদেরকে পরাভুত করার মতবিশ্বে কেউ নেই আজ সেই সকল দেশগুলিও করোনার প্রকোটে দিশেহারা এবং ইতিমধ্যেই জার্মানের একমন্ত্রী এই পরিস্থিতিকারনে মানসিক যন্ত্রনা নিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।
মনুষ্য দ্বারা যে সিদ্ধান্ত নিবে তা সম্ভবত আগামী কয়েক বছর ধরে বিশ্বকে এক নতুন রূপে অবয়ব দিবে। এগুলি কেবলমাত্রআমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার জন্যই নয় বরং আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, শিল্পসংস্কৃতিকেও একটি নতুনরূপে রূপায়িত করতে বাধ্য হবে।আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের চিন্তা ও সিদ্ধান্তগুলো হতে পারেস্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী। আমরা বলতে পারি আমরা এখন একটি মারাত্মক টাইফুন কিংবা টর্ণেডোর মধ্যে বসবাস করছি।এখন আমাদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন নিজেদের সারভাইব করা।
আশাবাদী হয়ে যদি বলি হ্যাঁ, ঝড় এক সময় কেটে যাবে, মানব জাতি বেঁচে যাবে এবং করোনা উত্তর বিশ্বে মানবজাতি এক নতুন বিশ্বে বসবাস করবে।করোনা ভাইরাসের সংক্রমন এবং একে ঠেকাতে যত পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী গ্রহন করা হয়েছে-- এই বিষয়গুলো আমরা কিভাবেকাজ করি আর কি কি ভোগ-বিলাস করি তাতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে।ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এ ধরনের সংকট আমাদের আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক পরিবর্তন এনে থাকে।
বড় ধরনের সংকট অতিক্রম করারমধ্য দিয়ে সমাজে নতুন নীতি, কাজ করার পদ্ধতি, নিত্য নতুন প্রয়োজন ও সেসব প্রয়োজন মেটানোর উপায় বেরিয়ে আসে।এর মধ্যে কিছু কিছু পরিবর্তন ক্ষণস্থায়ী আবার কিছু কিছু ব্যবস্থা স্থায়ী ভাবে টিকে যায়। যেমন:- প্রথমত: চতুর্দশ শতাব্দীদেবুবোনিক প্লেগে ইউরোপে প্রায় তিন কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল।ইতিহাসবিদরা এই মহামারীকে ইউরোপ মহাদেশের মধ্যযুগ থেকে স্বর্ণযুগে পদার্পণ হিসাবে দেখেন।
কেননা এই মহামারীর পরই সেখান হতে সামন্তযুগের পতন হয়। দ্বিতীয়ত:২য়বিশ্বযুদ্ধের পর কর্মক্ষেত্রে নারীর অবাধ প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কেননা, যুদ্ধে অসংখ্য পুরুষের মৃত্যু ঘটেছিল।তৃতীয়ত: ৯/১১ এর পর সারা বিশ্বে পরিবহন ও নিরাপত্তা নীতিতে আমুল পরিবর্তন নিয়ে আসে। ঐ ঘটনার পর ব্যক্তিগতগোপনীয়তার ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে। নিরাপত্তার বাড়তি কড়াকড়ি আর নজরদারির ব্যাপারগুলোমানুষ মেনে নিয়েছিল বৃহত্তর নিরাপত্তার স্বার্থে।
তবে এটা সত্য যে, এখন চুপ করে বসে আগের দিনগুলোতে ফেরত যাওয়ার আশায় না থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো সংকট পরবর্তীবিশ্বের জন্য কিভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা উচিৎ। করোনা উত্তর বিশ্বে যে পরিবর্তন আসতে পারেতাহলো: বাড়ি থেকে কাজ করা, ক্যাবল ইন্টারনেটের মাধ্যমে দুরত্ব বজায় রেখে কাজ করা, স্কুল-কলেজসহ শিক্ষা ব্যবস্থাঅনলাইনে নিয়ে আসা।
সাধারণত: সরকার ও প্রশাসন আমলাতান্ত্রিক দুর্ণীতিকে টিকে রাখার জন্য এ জাতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাকরতে সম্মত হয় না, তবে করোনা পরবর্তীতে এইসব বিষয়গুলো প্রকৃতপক্ষেই নতুন করে মানবজাতিকে ভাবাতে বাধ্যকরবে।কোভিড-১৯ এর কারনে বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশের বেশী শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম বিঘিœত হয়ে আছে। বর্তমানপরিস্থিতিতে ইউনিসেফ সহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশই শিশুদের রেখাপড়া অব্যাহক রাখতে উল্লেখযোগ্য হারে সহায়তা বৃদ্ধিরঘোষণা দিয়েছে এবং এর আওতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোকে নিরাপদ রাখার পদক্ষেপও নেওয়া প্রয়োজন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত শিশুদের ও স্কুলে কর্মচারীদের ভাইরাসের ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশের স্কুলগুলোও বন্ধ করতে হয়েছে। এইনজিরবিহীন পরিস্থিতিতে যাতে বাড়ীতেই বিভিন্ন বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের লেখাপড়া অব্যাহত রাখা যায় এবংবর্তমানের করোনা ভাইরাসজনিত নেতিবাচক পরিস্থিতির কারনে এর নেতিবাচক প্রভাব যাতে শিশু ও সমাজের উপর নাপরে সেজন্য সরকার ও অভিভাবক সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।
পূর্ব অভিজ্ঞতা হতে দেখা যায়, শিশুরা যত বেশী সময় স্কুল থেকে দুরে থাকে, তাদের স্কুলে ফেরার সম্ভাবনা ততটাই কমে যায়। তাই এই কোভিড- ১৯ মোকাবেলায় শিশুদেরলেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিকল্প পদ্ধতি তৈরীর দিকে মূলত: সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। শিক্ষাখাতে বিশেষ করেপ্রাথমিক শিক্ষাস্তরে সরকারের যে অর্জন রয়েছে তা অব্যাহত রাখার জন্য ইউনিসেফের সহায়তায় বন্ধ থাকা স্কুলের শিশুদেরলেখাপড়া অব্যাহত রাখতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রনালয়কে সহায়তায় শিক্ষা কার্যক্রমকে নিয়ে এগিয়েযেতে পারে।
ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে শিশুরা যাতে যথাযথ সামাজিক দূরত্বে থাকে সেজন্য টিভি, রেডিও, মোবাইল ফোনও ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সহযোগিতার লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পারেইউনিসেফ। এই উদ্যোগে শিশুদের লেখাপড়া হবে অংশগ্রহনমূলক, এতে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের যুক্ত করা হবে, শিক্ষার্থীর অংশগ্রহনের ওপর নজর রাখা হবে এবং সাথে সাথে শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখতে পারছে তার মূল্যায়ন করা হবে।
বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা পাথওয়ের গবেষক জনাব আলী আমজাদ মনে করেন এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তিনিআরও বলেন, এটা অত্যন্ত ইতিবাচক যে, সরকারকে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ইউনিসেফ ইতিমধ্যে সহযোগীতা শুরু করেদিয়েছে। এর আওতায় ধারণকৃত ক্লাস সংসদ টেলিফিশনে সম্প্রচার করা হবে, যার মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়েরশিশুরা ঘরে বসে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবে।
সরকার ও ইউনিসেপের মধ্যে এই অংশীদারিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজহবে ছেলে-মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে তাদের কীভাবে লেখাপড়া চালিয়ে নিতে সহযোগিতা করা যায়, সেই তথ্য বাবা-মাও অভিভাবকের কাছে পৌছে দেওয়া।