লিঙ্গগত বৈষম্যের কারণে আবহমান কাল থেকে সমাজে বিশেষ এক শ্রেনীর মানুষ হিজড়া সম্প্রদায়ে পরিচিতি লাভ করেছে।
এই সম্প্রদায়ের মানুষগুলো এই মাটির, এই দেশের কোন না কোনও মায়ের সন্তান। অথচ শারিরীক ও আচরণগত পার্থক্য দেখা দেয়ার সাথে সাথে পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র সর্ব ক্ষেত্রেই এই সম্প্রদায়ের মানুষগুলো নানা অবজ্ঞা, বঞ্চনা ও অবহেলার স্বীকারে পরিণত হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মক্ষেত্র কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা কোথাও তাঁদের মূল্য নেই। সবখানেই তারা হয়ে পড়ে উপেক্ষিত ও ঘৃনার পাত্র। পিতা—মাতা কিংবা সহোদর ভাই—বোন সবাই পরিচয় দিতে নারাজ। একদিন দু’দিন এমনিভাবে সময় গড়াতে গড়াতে এক সময় পরিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে ভাসমান জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। মৌলিক চাহিদার যোগান মেঠাতে লাজ— লজ্জাকে দূরে ঠেলে দিয়ে নানা পেশায় জড়িয়ে পড়ে নানা ভঙ্গে নানা ঢঙ্গে দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করে। তবুও জীবন থেমে থাকেনি। নিজেদের অধিকার আদায়ে লড়াই সংগ্রাম করে চলেছে বছরের পর বছর। যদিও সাংবিধানিক অধিকার এদের ক্ষেত্রে অনেকাংশে উপেক্ষিত।
দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হিজড়া সম্প্রদায়ের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করে তাঁদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে সহযোগীতা করেছে অনেক মানবাধিকার সংস্থা, সরকারী—বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন।
দীর্ঘ সময় ধরে পিছিয়ে থাকা এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলস্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করে দিতে ২০১৬ সাল থেকে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ‘‘পাথওয়ে’’ হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। বিশেষ করে বিনামূল্যে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে কর্মমুখী করে তোলা এবং সেলাই মেশিন প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
আর তারই ফলশ্রুতিতে তৃতীয় লিঙ্গের অনেকে গতানুগতিক পেশা ছেড়ে দিয়ে কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণের দিকে মনোযোগী হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে জ¦লন্ত ও উৎকৃষ্ঠ উদাহরণ হলো ‘‘বুলবুলি হিজড়া’’, সে পাথওয়ে ড্রাইভিং ট্রেনিং স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহযোগিতায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে একজন দক্ষ পেশাদার চালক হিসেবে কর্মসংস্থান বেছে নিয়েছে।
বুলবুলি’র মতো আরোও অনেকে নিজেদের জীবনমান পরিবর্তন ও ভাগ্য উন্নয়নের জন্য ‘পাথওয়ে’র মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন।
এই অবহেলিত সম্প্রদায়কে সমাজের মূলস্রোতধারায় সম্পৃক্তকরনে সবার আগে প্রয়োজন জীবন দক্ষতা ও আচরণগত প্রশিক্ষণ। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রয়োজন তাদের চাহিদা ভিত্তিক বিভিন্ন কর্মমুখী প্রশিক্ষণ ও নিজ পরিবারের পুণবার্সন নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমাজে তাদের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি আর এতে করে সমাজে তাদের গ্রহনযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী হবে।
মৌলিকভাবে ইসলাম মানুষকে পুরুষ ও নারীও হিসেবে গণ্য করে থাকে। যারা উভয়লিঙ্গ হয়ে থাকেন তারাও মূলতঃ হয় নারী কিংবা পুরুষ তাই তাদের প্রতি কোন আলাদা বিধান আরোপ করা হয় নি।
তবে উভয়লিঙ্গ ব্যক্তির মাঝে যেটি বেশি থাকবে তিনি সেই লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হবেন। অর্থাৎ গোপনাঙ্গ যদি পুরুষালী হয় তাহলে পুরুষ,
আর যদি নারীর মত হয় তাহলে সে নারী। ইসলাম হিজড়াদের সম্মান দিয়েছেন। ইসলাম তাদের আলাদা চোখে দেখে নি। অন্যান্য নারী পুরুষের মত সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করবে তারা।
তাদের ইবাদত বন্দেগীও হবে সাধারন ইবাদতের মত। এটাই ইসলামের নির্দেশ। ইসলামে হিজড়াদের অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে, অন্য সন্তানদের মত সম্পত্তিতে প্রাপ্য অধিকার পাবে। তাদেরও জানাজা এবং দাফন হবে। নামাজ রোজা ও পর্দা করবে লিঙ্গ অনুযায়ী।
তাই তাদেরকে ঘৃনা না করে স্নেহ, ভালবাসা দিয়ে পরিবার ও সমাজে অন্য দশ জনের মত বেড়ে উঠার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। মহান আল্লাহ তা আলার অনেক সৃষ্টির মাঝে মানব জাতিকে আশরাফুল মাকলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং, কোন মানুষকেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা যাবে না।
হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হলে এই অবহেলিত মানুষগুলো শিক্ষার সুযোগ পাবে খুব সহজেই। আমরা জানি, শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড একথা কাগজে কলমে লিপিবদ্ধ না রেখে ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে, আলোকিত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে হিজড়াদের ভূমিকাও হতে পারে অত্যন্ত প্রসংশনীয়।
তবে সময় এসেছে পিছিয়ে থাকা, পিছিয়ে পড়া ও পিছিয়ে রাখা সকলের জন্য উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি করা, যাতে তারা অন্যান্যদের মতো অগ্রগতির পথে অগ্রসর হতে পারেন। সবাই উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত হতে পারেন এবং সকলের মান মর্যাদা নিশ্চিত হতে পারে। মূলত হিজড়া সম্প্রদায় এখনও সমাজের মূল স্রোতধারার বাহিরে। কিন্তু বর্তমান সময়ে দেশ ডিজিটালাইজেশনের পাশাপাশি সব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই এখনই উপযুক্ত সময় এই অসহায়, অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোর টেকসই দারিদ্র বিমোচন ও মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে তাঁদেরকে সমাজের মূল স্রোতাধারায় যুক্ত করে বৈষম্য ও ভেদাভেদ ভুলে রাষ্ট্রের সুনাগরিক হিসেবে তাদের সকল অধিকার নিশ্চিত করা।
পাথওয়ে এর নিবার্হী পরিচালক মোঃ শাহিন এর মতে, অবহেলিত এই হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতি পরিবার, সমাজ, ও নিকট আত্মীয় সকলকে সর্বদাই ভাল ব্যবহার করতে হবে। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দিয়ে সবাইকে তাঁদের প্রতি সৌহাদ্যপূর্ণ আচরণের পাশাপাশি তাদের সবার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান এবং অন্যান্য যে সকল মৌলিক অধিকার রয়েছে সেদিকে নজর বাড়াতে হবে। তাদেরকে বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে কর্মক্ষেত্রে সমধিকারের সুযোগ তৈরি করে রাষ্ট্রের সকল উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই অবহেলিত হিজড়া সম্প্রদায়কে কাজে লাগাতে হবে।
তাদের প্রতি ঘৃণা না রেখে নিজের পরিবারের একজন সদস্য ভেবে সরকারী চাকুরির পাশাপাশি বেসরকারি চাকুরিতেও সমধিকার প্রদানের মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে বিভিন্ন কলকারখানায় কর্মের সুযোগ দিয়ে দেশের বেকারত্ব দুরীকরনে সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন। এবং বলেন এই দেশ আমার আপনার সবার। তাই এই দায়িত্ব শুধু আমার একার না বরং আমাদের সকলের। আমাদের দেশে যে সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেই সকল প্রতিষ্ঠান হিজড়াদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে আর্থিক সহযোগীতার ও ব্যবসা করার সুযোগ করে দিতে পারে। এক্ষেত্রে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা পাথওয়ে ইতিমধ্যে হিজড়াদের বেকারত্ব দূরীকরণে এবং তাদেরকে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী করতে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যার দৃষ্টান্ত হতে পারে সুদীর্ঘ বছরের ইতিহাসে মাইলফলক। সবশেষে তিনি যে কথাটি অত্যন্ত আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেছেন, সেটি হলো— হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষগুলো আমাদেরই করো না কারো সন্তান। সুতরাং তাদেরকে পরিবারের বাইরে ঠেলে না দিয়ে অন্য সন্তানদের মতো বুকে আগলিয়ে রাখি। কেননা ওরাও আমাদের সত্যেই মহান আল্লাহতালার সৃষ্টি মানুষ। আপনার আমার পরিবার বিছিন্ন এই অসহায় সন্তানরাই আজকের হিজড়া সম্প্রদায়। হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে পাথওয়ে এর সাথে থাকার জন্য সবাইকে অনুরোধ রেখেছেন মোঃ শাহিন।